খরা কি? (What is Drought?), খরার ১০টি সংজ্ঞা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী

1

খরার সংজ্ঞা (Definition of Drought)

খরা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাবের কারণে ঘটে। খরার ফলে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে পানি, ফসল, পশুসম্পদ এবং মানবজীবনের উপর বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে স্বাভাবিক পানির চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য দেখা দেয়।

2

খরা কি? (What is Drought?)

খরা বলতে বোঝায় এমন একটি পরিস্থিতি যখন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে প্রয়োজনীয় পরিমাণে বৃষ্টিপাত হয় না। এর ফলে জমি শুষ্ক হয়ে যায়, ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয় এবং পানির সংকট দেখা দেয়। খরা শুধুমাত্র জলবায়ুর প্রভাব নয়; এটি মানবিক কার্যক্রমের ফলেও হতে পারে, যেমন বন উজাড় বা পানির অপচয়। বাংলাদেশের মতো কৃষিনির্ভর দেশে খরার প্রভাব অত্যন্ত মারাত্মক।

3

খরার ১০টি সংজ্ঞা

• আবহাওয়া ভিত্তিক সংজ্ঞা (Meteorological Definition):

যখন কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণের চেয়ে অনেক কম বৃষ্টিপাত হয়, তখন সেটিকে আবহাওয়া ভিত্তিক খরা বলে। 

জলবায়ু পরিবর্তন ভিত্তিক সংজ্ঞা (Climate Change-Based Definition): গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী শুকনো অবস্থা বা পানির অভাবকে খরা বলে। 

কৃষি সংজ্ঞা (Agricultural Definition): যখন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্দ্রতা থাকে না, যার ফলে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটে, তখন সেটি কৃষি খরা।

 হাইড্রোলজিক্যাল সংজ্ঞা (Hydrological Definition): যখন নদী, জলাধার, পুকুর, বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়, তখন একে হাইড্রোলজিক্যাল খরা বলে। 

অর্থনৈতিক সংজ্ঞা (Economic Definition): খরার কারণে যখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষত কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়, তখন সেটিকে অর্থনৈতিক খরা বলা হয়। 

পরিবেশগত সংজ্ঞা (Ecological Definition): যখন খরার কারণে জীববৈচিত্র্য, উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে, তখন সেটিকে পরিবেশগত খরা বলা হয়। 

মানবিক সংজ্ঞা (Humanitarian Definition): যখন খরার কারণে খাদ্য, পানি এবং অন্যান্য মৌলিক চাহিদার অভাব দেখা দেয় এবং মানুষের জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়, তখন একে মানবিক খরা বলা হয়। গবেষণা ভিত্তিক সংজ্ঞা (Scientific Definition): মাটির আর্দ্রতা, জলবায়ু তথ্য, এবং পানির প্রাপ্যতার ওপর গবেষণার মাধ্যমে খরাকে নির্ধারণ করা হয়, যেমন: "যখন মাটির আর্দ্রতার মাত্রা ৩০% এর নিচে নেমে যায়।" 

প্রাকৃতিক সংজ্ঞা (Natural Definition): খরা একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যা দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের অভাবে ঘটে। 

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে সংজ্ঞা: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খরা হলো এমন একটি অবস্থা, যখন উত্তরাঞ্চল বিশেষত রাজশাহী ও রংপুরে দীর্ঘ সময় বৃষ্টিপাত হয় না এবং কৃষি ও পানির সংকট দেখা দেয়।

1. খরার ১০টি সংজ্ঞা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী

4

খরার ১০টি সংজ্ঞা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং ক্ষেত্র অনুযায়ী

খরা এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পানির প্রাপ্যতা চাহিদার তুলনায় কম হয়ে যায়, যা কৃষি উৎপাদন এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। 

WHO (World Health Organization): খরা হলো একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা দীর্ঘ সময় ধরে পানির ঘাটতি তৈরি করে এবং এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

IPCC (Intergovernmental Panel on Climate Change): খরা জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট দীর্ঘস্থায়ী শুষ্ক আবহাওয়া, যেখানে বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক চক্র বিঘ্নিত হয় এবং এটি বাস্তুসংস্থান ও কৃষি ব্যবস্থার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। 

UNCCD (United Nations Convention to Combat Desertification): খরা এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের অভাবে ভূমি ক্রমাগত শুষ্ক হয়ে পড়ে এবং এটি মরুকরণের দিকে অগ্রসর হয়। 

NASA (National Aeronautics and Space Administration): খরা হলো এমন একটি পরিস্থিতি যা স্যাটেলাইট ডেটার মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়, যেখানে মাটির আর্দ্রতা, পানি প্রবাহ, এবং সবুজ উদ্ভিদের স্তর উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। 

USGS (United States Geological Survey): খরা একটি ভূ-প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া যা দীর্ঘ সময় ধরে পানির প্রাপ্যতার ঘাটতি সৃষ্টি করে এবং এটি নদী, জলাধার এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের ওপর প্রভাব ফেলে।

 World Bank: খরা হলো একটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যা যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে পানি ব্যবস্থাপনা এবং কৃষি উৎপাদনক্ষেত্রে। 

WMO (World Meteorological Organization): খরা হলো দীর্ঘমেয়াদি বৃষ্টিপাতের ঘাটতি, যা একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের আবহাওয়া ও জলবায়ুর স্বাভাবিক প্রবাহকে ব্যাহত করে। 

IUCN (International Union for Conservation of Nature): খরা এমন একটি পরিবেশগত বিপর্যয় যা জীববৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক সম্পদগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। 

UNESCO (United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization): খরা হলো পানির সংকট যা মানুষের জীবন, সংস্কৃতি, এবং প্রাকৃতিক ঐতিহ্যের ওপর প্রভাব ফেলে। এটি মানব সভ্যতার টেকসই উন্নয়নের জন্য একটি বড় হুমকি।

5

বাংলাদেশের খরার উল্লেখযোগ্য ঘটনা

১৯৭৯ সালের খরা ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বড় ধরনের খরা দেখা দেয়। এর ফলে কয়েক লক্ষ মানুষ খাদ্য ও পানির সংকটে পড়ে। ২০১০ সালের খরা ২০১০ সালে রাজশাহী অঞ্চলে দীর্ঘ তিন মাসের খরা দেখা দেয়। কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। সাম্প্রতিক খরা ২০২৩ সালে উত্তরাঞ্চলে আবারও খরা দেখা দেয়, যার ফলে তিস্তা নদীর পানির স্তর সর্বনিম্নে নেমে যায়।

6

খরার ধরন (Types of Drought)

খরাকে বিভিন্নভাবে শ্রেণিবদ্ধ করা যায়। এখানে খরার ১০টি প্রধান ধরন উল্লেখ করা হলো: 

• আবহাওয়া জনিত খরা (Meteorological Drought): যখন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় দীর্ঘ সময় ধরে স্বাভাবিকের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে প্রায়ই এই ধরনের খরা দেখা যায়। 
• জলবায়ু জনিত খরা (Climatological Drought): দীর্ঘস্থায়ী তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটে। এটি গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের সাথে সম্পর্কিত। 
• কৃষি খরা (Agricultural Drought): যখন মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ আর্দ্রতা থাকে না এবং ফসল চাষ ব্যাহত হয়। উত্তরবঙ্গের কিছু এলাকায় শস্য উৎপাদনে এই ধরনের খরার প্রভাব স্পষ্ট। 
• হাইড্রোলজিক্যাল খরা (Hydrological Drought): যখন নদী, জলাধার, পুকুর ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, তিস্তা নদীর পানি সংকট। 
• অর্থনৈতিক খরা (Economic Drought): যখন খরার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষত কৃষি ও শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হয়। 
• পরিবেশগত খরা (Ecological Drought): যখন খরার প্রভাব পরিবেশের জীববৈচিত্র্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্যের উপর খরার প্রভাব। 
• শিল্প খরা (Industrial Drought): যখন শিল্পকারখানাগুলোর জন্য পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ সম্ভব হয় না।
•  শক্তি খরা (Energy Drought): হাইড্রোপাওয়ার উৎপাদনের অভাবে ঘটে। 
• গৃহস্থালির খরা (Domestic Drought): যখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য পর্যাপ্ত পানি থাকে না। 
• খাদ্য খরা (Food Drought): খরার ফলে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পেয়ে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।

7

১০টি সাধারণ জিজ্ঞাসা (FAQ) খরা সম্পর্কে

খরা কি? 

খরা হলো দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাতের অভাবে সৃষ্ট পানির সংকট। 

বাংলাদেশে কোথায় বেশি খরা দেখা যায়? 

উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজশাহী, রংপুর এবং দিনাজপুর অঞ্চলে। 

খরার প্রধান কারণ কি? 

দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত না হওয়া, বন উজাড়, এবং জলবায়ু পরিবর্তন।

 খরা কীভাবে মাটির উপর প্রভাব ফেলে? 

মাটি শুষ্ক ও উর্বরতাহীন হয়ে পড়ে। 

কৃষি খরা বলতে কী বোঝায়? 

যখন মাটির আর্দ্রতার অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়।

 খরা মোকাবিলায় কী ভূমিকা নিতে পারি? 

পানি সংরক্ষণ, বনায়ন, এবং খরা-সহনশীল ফসল চাষ। 

বাংলাদেশে খরার বড় উদাহরণ কী কী? 

১৯৭৯ এবং ২০১০ সালের খরা। 

খরা কি শুধু বাংলাদেশেই ঘটে? 

না, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। 

খরার ফলে পানির স্তর কীভাবে প্রভাবিত হয়? 

ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। 

খরা কীভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে? 

জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং মাটি উর্বরতাহীন হয়।

8

রেফারেন্সের সাধারণ তালিকা

1. রেফারেন্সের সাধারণ তালিকা 

1.  FAO (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা): খরা এবং কৃষি উৎপাদনের উপর প্রভাব। 
2. WHO (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা): খরার ফলে জনস্বাস্থ্য ও পুষ্টির সমস্যা।
3.  IPCC (আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তন প্যানেল): খরা ও জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক। 
4. UNCCD (মরুকরণ প্রতিরোধের জাতিসংঘ সম্মেলন): খরা ও মরুকরণের কারণ। 
5. WMO (বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা): খরার আবহাওয়াগত সংজ্ঞা এবং পূর্বাভাস। 
6. বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI): খরা-সহনশীল ফসল উদ্ভাবন। 
7. বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (BWDB): পানির সংকট ও সেচ ব্যবস্থার উন্নতি। 
8. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা: উত্তরাঞ্চলে খরার প্রতিক্রিয়া। 
9. তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা: জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। 
10. বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS): খরা-সংক্রান্ত অর্থনৈতিক তথ্য।